প্রতিদিনের রবীন্দ্রনাথ : নীলোৎপল জানা
প্রতিদিনের রবীন্দ্রনাথ
“ বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা
বিপদে আমি না যেন করি ভয়
দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে নাইবা দিলে সান্ত্বনা।
দুঃখে আমি না যেন করি ভয়
।"--- রবীন্দ্রনাথ
প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ
মনে তেমন ভাবে ধরা দেয়নি। চতুর্থ শ্রেণিতে যখন পড়ি ফাইনাল পরীক্ষায় রচনা লিখতে পড়েছিল
‘কবি রবীন্দ্রনাথ’। ঠিক কি লিখেছিলাম এখন মনে নেই তবে যখন সামাজিক বোধ ও জীবন সম্পর্কে
জানার ইচ্ছা জাগল তখন কিভাবে যেন সমস্ত সত্তা রবীন্দ্রময় হয়ে উঠল। মনে হতে থাকল জন্ম
থেকে মৃত্যু পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বোধ হয় উপায় নেই।
তখন দশম শ্রেণিতে পড়ি। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে
কি'বা জানি। ক্লাসে দু-পাঁচটা গদ্য কবিতা ও গল্প ছাড়া আর কিছুই পড়া হত না। বলতে পারেন
পড়ার জন্য পড়তাম। সেই সময় রবীন্দ্রসংগীত শেখার জন্য বাবা আমার জন্য শিক্ষক ঠিক করলেন।
বাড়িতে এলো নতুন হারমোনিয়াম। মাস্টার মশাই সপ্তাহে দুদিন বিকালে এসে গানের তালিম
দিতে শুরু করলেন। প্রথমেই সা রে গা মা পা; তারপর বেশ কিছুদিন বাদে রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে
গান শেখানো শুরু। এখনো আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে কিছু কথা। প্রথম গানটি ছিল-
“আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্ব ভরা প্রাণ
তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।’’
মাস্টারমশাই শুধু গানটি শেখাননি
তিনি ব্যাখ্যা করে গানটি বোঝাবার চেষ্টা করলেন। আমি বলে বোঝাতে পারব না সেদিন সারারাত
ঘুমোতে পারিনি, মাথার মধ্যে তোলপাড় করছিল কতগুলো শব্দ। সূর্য, তারার মতো বিশ্বময়
প্রাণ ছড়িয়ে আছে এটা ভেবেই যেন আমি অভিভূত হয়েছিলাম। সেই বিস্ময় থেকে পরবর্তী সময়ে
রবীন্দ্রনাথের প্রতি যেন একটা পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। এরপর থেকে কখনোই
ভাবিনি যে রবীন্দ্রনাথ অন্য কোনো মানুষ। বারবার মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথ শুধু আমার,
আমারি।
রবীন্দ্রনাথকে জানার আগ্রহ থেকেই; যখনই রবীন্দ্রনাথের
উপর লেখা কোনো নতুন বই দেখতে পাই তৎক্ষণাৎ কিনে ফেলি। প্রচন্ড ক্ষুধার্ত অবস্থায় থাকলেও
না খেয়ে সেই বইটি কেনার চেষ্টা করি। এরপর কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে যখন লেখার
জগতে এসেছি তখন রবীন্দ্রনাথকে লিখে ফেলি পরপর কয়েকটি গ্রন্থে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে
আমার সংগ্রহে কম করে আড়াইশোর বেশি বই আছে। আজও বিপদে পড়লে বা একলা হয়ে গেলে বারবার
কবির সেই গানটি মনে পড়ে-
“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে
তবে একলা চলো রে…”
বা বলে উঠি-
“আনন্দধারা বহিছে ভুবনে…”
মাঝে মাঝে আমার সহকর্মীরা যখন
গল্প করতে করতে চাকরি ছাড়ার পর কে কি করবে বলতে থাকেন তখন বলে ফেলি- ‘আমার তো রবীন্দ্রনাথ
আছেন, জীবনে আর কিছু চাওয়ার নেই।’
তবুও এই চলমান জীবনে মৃত্যু চিন্তা মাঝে মাঝে
জীবনে হানা দেয়। কিন্তু এই মৃত্যু ভয় যদি জীবনে থাকে তাহলে কোনো কাজই সহজে করা যায়
না। কবি বলেছেন মৃত্যু ভয়কে ত্যাগ করতে। ত্যাগ করতে পেরেছি কিনা জানিনা তবে এই শিক্ষা
আমি পেয়েছি কবির গান থেকে-
“আমারে তুমি করিবে ত্রাণ এ নহে মোর প্রার্থনা
তরিতে পারি সকতি যেন রয়।”
আলোচনার শেষে এসে বলতে চাই আসলে ঈশ্বর যেন কবি
হয়ে জন্মেছিলেন। তাই রবীন্দ্রনাথই আমাদের কাছে প্রতিদিনের, প্রতিক্ষণের ঈশ্বর।
কোন মন্তব্য নেই
ok