লোকভাষা: ড. নীলোৎপল জানা
লোকভাষা
ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি |
লোকভাষা
ভাষা নদীর মতো বহমান। পৃথিবীতে মানবজাতির আশ্চর্য
সৃষ্টি হল ভাষা। পশু-পাখিদের কণ্ঠনির্গত ধ্বনি শুনে মানুষ হয়তো অর্থপূর্ণ ধ্বনি সৃষ্টি
করেছিল। তবে সব ভাষাই আদিপর্বে ছিল লোকমুখে, যাকে বলা যায় লোকভাষা। কোনো কোনো সমালোচক
বলেছেন-'লোকভাষাই ভাষার মূল বুনিয়াদ।' কোনো মানবজাতির মুখের ভাষা ব্যাকরণ বা সূত্র
মেনে গড়ে ওঠেনি তাই ভাষা বংশের তত্ত্বগত স্বাতন্ত্র্য সুরক্ষিত। বাংলা-ভাষার আদি মৌখিক
রূপ আজ আর জানা যায় না কারণ তার দৃষ্টান্ত পাওয়া কষ্টকর; কালের প্রবাহে তা পরিবর্তিত
হয়েছে।
ভাষা বলতে language কে বুঝি যার সঙ্গে ভৌগোলিকতার যোগ অবশ্যম্ভাবী। ভাষা প্রথমে মৌখিক অর্থাৎ কথ্য। পরে তা লৌকিক রূপ ধারণ করে মানুষের সুবিধার্থে। মুখে মুখে যে ভাষা ব্যবহৃত হয়ে এসেছিল তাকে পরবর্তী সময়ে 'dialect' বলা হয়েছে। এই dialect এর বাংলা হল 'উপভাষা'। এই উপভাষা পশ্চিমবঙ্গে পাঁচ ভাগে বিভক্ত-রাঢ়ী, বঙ্গালী, কামরূপী, বরেন্দ্রী, ঝাড়খণ্ডী এগুলো হলো বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রূপভেদ। যাই হোক আমাদের আলোচনার বিষয় হলো লোকভাষা। ১৯৬৪ সালে সমাজভাষা বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনায় Folk linguistics কথাটির উল্লেখ থাকলেও এর কোনো সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। তবে আমরা এর বাংলা করেছি লোকভাষা। তবে লোকভাষা মানে dialect মানতে কষ্ট হয়।
লোকভাষা সম্পর্কে
বিদগ্ধ ব্যক্তিদের মতামত-
১. ভাষাবিদ ডঃ পবিত্র সরকার লিখেছেন: "... ..... Folk language-এর বাংলা হিসেবে 'গ্রাম্যভাষা' কথাটি সুপারিশ করি 'লোকভাষা' নয়।" আরও বলেছেন: “লোকভাষা কোনো অঞ্চল বিশেষের উপভাষা নয়।.... আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানে একে কখনও-কখনও rural language-ও বলা হয়, যা থেকে rural linguistics কথাটি তৈরি হয়েছে।"
২. "লোকভাষা খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা। কৌলীন্যবর্জিত, কৃত্রিমতামুক্ত লোকভাষা দেশে-দেশে হাজার হাজার বছর মুক্তধারার মতো বয়ে চলেছে লোকমুখে। "-ড. ভক্তিপ্রসাদ মল্লিক ("বাংলার লৌকিক ভাষা' প্রবন্ধ)।
৩. লোক (Folk) নামে অভিহিত নগর থেকে বহুদূরবর্তী অরণ্য-পর্বতবাসী অপরিশীলিত জীবনাচরণে অভ্যস্ত অশিক্ষিত মানুষের মুখে মুখে ব্যবহৃত ভাষাই লোকভাষা।
8. ড. সুধীরকুমার করণ বলেছেন-"সামাজিক স্তর বিন্যাসের প্রাথমিক পর্যায়ভূক্ত কৃষক-শ্রমজীবী মানুষের প্রাত্যহিক ভাব প্রকাশের বাহন এই লোকভাযাই ভাষার মূল বুনিয়াদ।.... লোকভাষার সঙ্গে লোকসংস্কৃতির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বর্তমান।" ড. করণ লোকভাষাকে 'Folk dialect' বলেছেন। (প্রবন্ধ- লোকভাষা: ড. সুধীরকুমার করণ)
৫. অনেকের এই অভিমত যে, আসল 'লোকভাষা' লোকসাহিত্যের ভাষা। লোকমানসের ভাব প্রকাশের ভাষা। লোক মুখে মুখে সৃষ্ট ছড়া-গান-গাথা- গল্প-ধাঁধা প্রবাদের ভাষা।
উক্ত সংজ্ঞাগুলি
যে একশত ভাগ সঠিক তা বলা বোধ হয় ঠিক হবে না। তবুও এই সংজ্ঞাগুলোর ভিত্তিতে কতগুলো সাধারণ
বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করা যায়-
২. আঞ্চলিকতা
ও গ্রাম্যতার প্রাধান্য সত্ত্বেও লোকভাষা , উপভাষা রূপে গণ্য হতে পারে না।
৩. লোকভাষা'র
কোনো স্থায়ী রূপ নেই- তা নিত্য পরিবর্তনমুখী।
৪. লোকভাষার
ক্ষেত্রে কোনো ব্যাকরণের অনুশাসন খাটে না।
৫. লোকভাষা
লোকমুখের ভাষা।
৬. ধন্যাত্মক
শব্দের বিচিত্র ও স্বতস্ফূর্ত প্রয়োগ লোকভাষার আর একটি বৈশিষ্ট্য। যেমন-'বৃষ্টি পড়ে
টাপুর টুপুর।'
৭. বাক্যে অব্যের
প্রয়োগ লোকভাষায় বেশি।
৮. শব্দের আদিতে অবস্থিত 'ও' ধ্বনি প্রায়ই 'উ'-রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন লোক > লুক
৯. লোকভাষায়
অর্থহীন শব্দ প্রয়োগ করা হয়। যেমন - 'এলাটিং বেলাটিং', 'আগডুম বাগডুম' ইত্যাদি।
১০. লোকভাষায়
বাক্যের হেরফের বেশি দেখা যায়।
১১. ভাষার চমৎকারিত্ব
সৃষ্টি ও সৌন্দর্য বাড়ানোর লক্ষ্যে অলংকারের ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন 'মন পবনের
নাও', 'মন মাঝি' অচিন পাখি।
১২. লোকভাষায়
সাধুভাষার ক্রিয়ারূপের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন 'উথাল পাথাল সাঁতার কাটিব।'
১৩. অপিনিহিতির
বিপর্যস্ত 'ই' ধ্বনি রক্ষিত হয়। যেমন- দেইখব, মেইরে, ধইরে।
৫নং বৈশিষ্ট্য থেকে আলোচনা আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে।
লোকভাষা ও উপভাষা
লোকমুখের কথ্যা ভাষা তবুও দুই ভাষাকে একই বলতে দ্বিধা হয়।
প্রথমত, উৎসগত
বিচারে বলা যায় লোকভাষা লোকসাধারণের ব্যবহৃত আদি কথ্য-ভাষা। আর এই ভাষা দীর্ঘদিন ধরে
পরিবর্তনের ফলে মার্জিত হয়ে উঠেছে। সময়ে সময়ে যে পরিবর্তন ঘটেছে তার আঞ্চলিক রূপ হল
উপভাষা। এখন যেমন শিষ্ট ভাষা উপভাষা, চলিত ভাষা প্রচলিত আছে তেমনি লোকভাষাও প্রচলিত।
দ্বিতীয়ত, আদি
ও বর্তমান লোকভাষা কোনো স্থায়ী নিয়মে বাঁধা নয়; কিন্তু উপভাষা, চলিত ভাষা, শিষ্ট ভাষা
স্থায়ী বৈশিষ্ট্যে বিদ্যমান।
তৃতীয়ত, লোকভাষা মূলত গ্রাম্য ভাষা কিন্তু গ্রামেও ছোটো শহরে উপভাষা কথ্য ভাষা হিসাবে প্রচলিত এবং লিখিত সাহিত্যে ঠাঁই পেয়েছে। লোকভাষা আজও সাহিত্যে ব্রাত্য।
চতুর্থত, লোকভাষার
সঙ্গে শিষ্টভাষার সম্পর্ক অস্পৃশ্য কিন্তু উপভাষার সঙ্গে লোকভাষার দূর সম্পর্ক বিদ্যমান।
আমরা যে যাই
বলি না কেন লোকভাষা আর ব্রাতা নয়, উপভাষা, বিভাষা, সমাজভাষা, সংখ্যালঘুর ভাষার সঙ্গে
মিশ্রিত হয়ে লেখ্যভাষার ঘেরাটোপে বন্দি হচ্ছে, ফলে লোকভাষা তার নিজস্ব রূপ হারাচ্ছে।
কোন মন্তব্য নেই
ok