Translate

নল সংক্রান্তি (লোকসংস্কৃতি) :ড. নীলোৎপল জানা

 

ধান গাছের সাধভক্ষ অনুষ্ঠান হল নল সংক্রান্তি

ড.নীলোৎপল জানা

          ========================================

   রাঢ় বঙ্গের কৃষক সম্প্রদায়ের বড় লোকাচার হল নল সংক্রান্তি। আজ যখন এ বিষয়ে লিখতে বসেছি মাত্র কয়েকদিন আগে এই লোকাচর সমাপ্ত হয়েছে। কৃষিজীবী পরিবারের বড় হয়ে ওঠার করণে এই প্রথা শৈশব থেকেই দেখেছি। গ্রামীণ লোকাচার নলসংক্রান্তি আর ডাকসংক্রান্তি দুটোই একই; শুধু অঞ্চলভেদে আলাদা রকম নাম। তবে আমাদের এলাকায় এই প্রথাটিকে নলসংক্রান্তি বলে। আশ্বিন মাসের শেষদিন অর্থাৎ সংক্রান্তির দিনে এই প্রথাটি পালিত হয়৷ এইসময় হল ধানগাছে ফসল আসার সময়, ধানগাছে ফুল হয়,অর্থাৎ ধানগাছ গর্ভবতী হয়৷ আর ধানের ভেতরের অংশটি এই সময়ে একেবারে নরম থাকে ,দুধের মতো। যেটি পরবর্তী পর্যায়ে চালে পরিণত হয়। এই নরম মিষ্টি দুধ অংশটি পোকামাকড়ের খুব প্রিয়। ফলে ধানের উপর পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়ে যায়। এরা ধানের দুধ অংশটি শুষে নেয়। ধানের পুষ্টি হয় না। ধান থেকে চাল পাওয়া যায় না, সব আগড়া অর্থাৎ শাঁশ হীন  হয়। ফলে কৃষকের মাথায় হাত। কৃষক পরিবারগুলি দুঃখের সীমা থাকে না। তখন ফসল বাঁচাতে কৃষকরা টোটকা অবলম্বন করতেন, পরে সেটিই লোকাচার হিসেবে প্রচলিত। কৃষকরা নল সংক্রান্তি অনুষ্ঠানকে ধান গাছের সাধভক্ষণ বলে মনে করেন 

 

   আমাদের শৈশবে দেখতাম আশ্বিন মাস শেষের আগের দিনে নল গাছ কেটে আনা হত। আমিও নল কাটার কাজ করেছি কয়েক বছর । আমাদের বাড়িতে এই লোকাচার, উৎসবের রূপ নিত। আমার দাদু,বাবা ,কাকুকে  দেখতাম নিম, ওল, আদা, কালমেঘ, বেলপাতা, তুলসী, নটে খাড়া,  বয়েড়া, মানকচু, চাল কুমড়ো খাড়া, কেতকী, শশা গাছ ইত্যাদি দশ বার রকমের ভেষজ খুব ছোটো ছোটো করে কুচি করতেন তার সঙ্গে আতপ চাল মিশিয়ে নেওয়া হত। এরপর ঐ মিশ্রণটিকে বড় বট পাতা দিয়ে মুড়ে নলগাছে পাট জড়িয়ে তাঁরা বাঁধতেন। মুখে কোনো কথা বলতেন না। কথা বললে না’কি ঔষধী গুণ নষ্ট হয়। সারা গ্রামে চাষীরা নিজে নিজেই রাত জেগে নল বাঁধার কাজ করত। সংক্রান্তির দিন ভোরে সূর্যের আলো ফোটার আগেই এই মিশ্রণবাঁধা নলটি জমিতে ঈশান কোণে পুঁতে দেওয়া হত। আর বলা হতো---

                                                 "নল পড়ল ভুঁয়ে

 যা শনি তুই উত্তর মুয়ে।" 

এখানে শনি অর্থাৎ সব পোকামাকড়কে বোঝানো হয়েছে। এটাকেই গর্ভবতী ধান গাছকে 'সাধ খাওয়ানো'র কথা বলেন কৃষকেরা ৷ নল সংক্রান্তিতে নলপোতা নিয়ে লোকমুখে প্রচলিত ছড়া--- 

অন সরিষা কাঁকুড় নাড়ি

   যা রে পোকা ধানকে ছাড়ি

এতে আছে শুকতা

ধান ফলবে মুকতা

এতে আছে কেঁউ

ধান হবে সাত বেঁউ

এতে আছে হলদি

ধান ফলবে জলদি

এতে আছে ওল

মহাদেবের ধ্যান করে বল হরিবোল।

মহাদেব এখানে শস্যের দেবতা হিসাবে পূজিত।

 

   বাস্তব  দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে যেটা দেখা যায় তা হল এই ফসল বাঁচানোর প্রথাটির যখন প্রচলন শুরু হয় তখন আজকের দিনের মত এত কীটনাশক ঔষধ বা রাসায়নিক সারের আবির্ভাব ঘটেনি। কীটপতঙ্গের হাত থেকে ফসলকে রক্ষা করার জন্য এই মিশ্রণটি তৈরি করা হত, এটি তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ যুক্ত ছিল যে পোকামাকড় সহজেই আর ফসলের এলাকায় আসত না। রক্ষা পেত কৃষকের ফসল৷ এ যুক্ত কতটা গ্রাহ্য জানি না তবে কৃষকদের বিশ্বাস ছিল এ লোকাচারের উপর। শুধু তাই নয়, আবার জমির মাঝে এই যে নলগাছ পুঁতে রাখা হয় সেটিতে লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা প্রভৃতি প্রাণীরা এসে বসে এবং সেখান থেকে তারা খুব সহজেই ফসলের ক্ষতিকারক প্রাণীগুলিকে শিকার করে৷ এর লের পোকার উপদ্রব কমে। পুরো ব্যাপারটিতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষে উপকৃত হয় কৃষক৷ ফল লোকচারটি সমাজে প্রচলিত থাকে।

                                          নল পোঁতা হয়েছে

   এই সংক্রান্তির ভোরে নিমপাতা আর হলুদ বেটে সকলকে মাখত হত।বিশ্বস ছিল এতে নাকি শরীর সকল রোগ থেকে মুক্ত হবে। দুই মেদিনীপুর জেলায় এই দিন সকালে প্রতি বাড়িতে এই নিম পাতা হলুদ বাটা মাখর প্রথা চালু রয়েছে। ঐ সময় খাওয়া হয় তাল আটির গজাড়। এদিন দুই-তিন রকমের পিঠে তৈরী হয়। মধ্যাহ্ন ভোজনের সময় অন্যান্য তরিতরকারীর সাথে পাঁচ,সাত বা নয় রকমের শাক ভাজা খাওয়ার প্রথা আছে। তাছাড়া এদিন বাড়ির গরুকেও কাঁচা হলুদ ও নিম পাতা খাওয়ানোর রীতি রয়েছে। যদিও আজকে এলাকার বেশিরভাগ মানুষের ধানের জমি পরিনত হয়েছে ভেনামি মাছ চাষের ঝিলে। যেটুকু খালি জমি আছে তাতেও সমুদ্রের নোনা জল থৈ থৈ করছে। ঘাসের জঙ্গলে ভরে গেছে। বাংলার লোকাচার নিয়ে অনেক কথা প্রচলিত আছে পল্লীসমাজে যেগুলো সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ হারিয়ে যাবার উপক্রম। বেশিরভাগ লোকাচার হারিয়ে গেছে আধুনিকতার দাপটে হয়তো আগামী বিশ-ত্রিশ বছর বাদে আর লোকাচার কী জানবে না নতুন প্রজন্ম।

 

 


কোন মন্তব্য নেই

ok

4x6 থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.